অযোধ্যার পর ওয়েলেসলির নজর পড়ে মারাঠাদের দিকে। পুণা দরবারে তখন গৃহযুদ্ধ চলছিল। সেই গৃহযুদ্ধে পেশোয়া দ্বিতীয় বাজীরাও পরাস্ত হলে, কোম্পানির পুণার প্রতিনিধি ক্যাপ্টেন মস্টিন দ্বিতীয় বাজীরাও কে বেসিনের অধীনতামূলক সন্ধি (১৮০২) স্বাক্ষর করতে প্ররোচিত করেন। এই সন্ধির দ্বারা পেশোয়া তাঁর বৈদেশিক সম্পর্ক ও কূটনীতি কোম্পানির হাতে সমর্পণ করেন। পেশোয়ার খরচে পুণাতে ছয় হাজার ইংরেজ সৈন্য রাখার ব্যবস্থা করা হয়। পেশোয়া দ্বিতীয় বাজীরাও কে ইংরেজ সেনা ১৮০৩ খ্রিস্টাব্দে পুণার সিংহাসনে স্থাপন করে। পুণা দরবারে একজন ইংরেজ রেসিডেন্ট নিয়োগ করা হয়।
বেসিনের এই সন্ধি ছিল ওয়েলেসলির কূটনৈতিক দক্ষতার শ্রেষ্ঠ উদাহরণ। এই সন্ধির দ্বারা কোম্পানি কার্যতঃ দাক্ষিণাত্যে একাধিপত্য লাভ করে।
কিন্তু ভোঁসলে, সিন্ধিয়া, হোলকার প্রভৃতি মারাঠা সামন্ত সর্দার রা এই সন্ধি মানতে অস্বীকার করেন। ফলস্বরূপ দ্বিতীয় ইঙ্গ-মারাঠা যুদ্ধের সূত্রপাত হয়।
এই যুদ্ধের জন্য ওয়েলেসলি প্রস্তুত ছিলেন। ওয়েলেসলি মারাঠা সর্দার দের যুদ্ধে পরাজিত করেন এবং প্রত্যেকের সঙ্গে আলাদা আলাদাভাবে অধীনতামূলক চুক্তি স্থাপন করেন। ভোঁসলে রাজা পরাজিত হয়ে দেওগাঁয়ের সন্ধি (১৮০৩) ও দৌলত রাও সিন্ধিয়া পরাজিত হয়ে সুর্জি-অর্জনগাঁওয়ের সন্ধি (১৮০৩) দ্বারা অধীনতামূলক মিত্রতার শর্তাবলী মেনে নেন। ফলে প্রায় প্রত্যেক মারাঠা নেতা এখন থেকে কোম্পানির দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হতে শুরু করেন ও পেশোয়া মারাঠা সর্দার দের উপর নিয়ন্ত্রণ হারান। মারাঠা কনফেডারেশি চূর্ণ করার আকাঙ্ক্ষা ওয়েলেসলির পূর্ণ হয়। সকল মারাঠা নেতা কোম্পানির হাতের পুতুলে পরিণত হয়।
কিন্তু যশোবন্ত রাও হোলকার কোম্পানির বিরুদ্ধে গেরিলা যুদ্ধ নীতি অনুসরণ করে বীর বিক্রমে যুদ্ধ করতে থাকেন ও কোম্পানির অধিকৃত বহু অঞ্চল ছারখার করে কোম্পানিকে বিপন্ন অবস্থায় ফেলে দেন। দীর্ঘ যুদ্ধে কোম্পানির প্রভূত আর্থিক ক্ষতি হয়। ইংল্যান্ডে ওয়েলেসলির আগ্রাসন নীতির তখন চরম নিন্দা শুরু হয়। ইংল্যান্ডের পরিচালক সভা ওয়েলেসলিকে বাধ্যতামূলকভাবে ইস্তফা দিয়ে স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের নির্দেশ দেয়।
ইংরেজ সেনাপতি লর্ড লেক হোলকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে থাকেন ও অবশেষে হোলকার কে পরাস্ত করে রাজপুরঘাটের সন্ধি (১৮০৬) স্থাপন করেন।
দ্বিতীয় ইঙ্গ-মারাঠা যুদ্ধ ছিল ওয়েলেসলির অধীনতামূলক মিত্রতা নীতির মাধ্যমে রাজ্য বিস্তারের শেষ পর্যায়। তিনি ভারতের এক বিশাল অঞ্চল কোম্পানির অধীনে আনতে সমর্থ হন। ” ভারতের ভেতর অবস্থিত ব্রিটিশ সাম্রাজ্য এখন ভারতীয় ব্রিটিশ সাম্রাজ্যে পরিণত হয় ” ।
প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য, হোলকারের পরাজয়ের পর ইংল্যান্ডের পরিচালক সভা লর্ড কর্ণওয়ালিসকে পুনরায় (১৮০৫) গভর্নর জেনারেল হিসেবে ভারতে পাঠায়। ওয়েলেসলি নিরন্তর যুদ্ধের দ্বারা ভারতে যে পরিস্থিতি তৈরী করেছিলেন, তাকে স্থিতিশীল করার উপযুক্ত লোক হিসেবে অভিজ্ঞ সাবধানী প্রশাসক বয়সে বৃদ্ধ কর্ণওয়ালিসকেই বেছে নেওয়া হয়েছিল। তিনি ভারতে রাজনৈতিক বন্দোবস্তের একটি খসড়া তৈরী করেন এবং মতামত দেন যে কোম্পানি যতটা পরিমাণ রাজ্যে সুশাসন বজায় রাখতে সক্ষম, ঠিক ততটাই অধিগ্রহণ করা উচিত এবং বাকি অতিরিক্ত অঞ্চল বৈধ রাজাকে ফিরিয়ে দেওয়াই শ্রেয়। এই অতিরিক্ত নমনীয় নীতি অন্যান্য ব্রিটিশ অফিসারদের একেবারেই মনঃপুত হয়নি। ইতিমধ্যে বার্ধক্যের কারণে তাঁর পাজিপুরে মৃত্যু হয় এবং তাঁকে এখানেই সমাধিস্থ করা হয়। তাঁর পরিকল্পনা আর রূপায়িত হয়নি।