লর্ড ওয়েলেসলির শাসনকালকে ভারতে ব্রিটিশ শক্তি বিস্তারের ক্ষেত্রে এক নতুন যুগের সূচনা বলা চলে। তিনি ছিলেন অভিজাত ইংরেজ, গ্রীক ও ল্যাটিন সাহিত্যের ভালো ছাত্র এবং ভারতবর্ষ সম্পর্কে সমকালীন ইংরেজদের মধ্যে সর্বাপেক্ষা ওয়াকিবহাল। পাশ্চাত্যের শ্রেষ্ঠত্বে তিনি ছিলেন ঘোর বিশ্বাসী এবং তাই তিনি মনে প্রাণে বিশ্বাস করতেন যে ভারতে ব্রিটিশ শাসনের প্রতিষ্ঠা হলে তা হবে ভারতবাসীর পক্ষে অত্যন্ত মঙ্গলময়। এজন্য ভারতীয় রাজাদের উচ্ছেদ অথবা ব্রিটিশ নিয়ন্ত্রণে এনে ভারতে ব্রিটিশ সার্বভৌমত্ব ( Pax Britannica) প্রতিষ্ঠা করাই তাঁর প্রধান লক্ষ্য হয়ে ওঠে। ভারতীয় রা আসলে কি চান সেদিকে চিন্তা ভাবনা করার মানসিকতা তাঁর কস্মিনকালেও ছিল না। তাঁর এই সাম্রাজ্যবাদী নীতির যৌক্তিকতা তিনি কোম্পানির পরিচালক সভা ও ব্রিটিশ মন্ত্রীসভাকে বোঝাতে সহজেই সক্ষম হন।
ওয়েলেসলি প্রধানতঃ যুদ্ধ ও কূটনীতিকেই প্রধান অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে তাঁর এই সাম্রাজ্যবাদী নীতি কার্যকর করেন এবং এর জন্য তিনটি পথ বেছে নেন –
(১) ভারতীয় রাজাদের এমন দৃড় নিয়ন্ত্রণে আনা যাতে ফরাসি রা ক্ষমতা বৃদ্ধির কোন সুযোগ না পায়
(২) ইংরেজ বিরোধী রাজাদের ক্ষমতা যুদ্ধের দ্বারা ধ্বংস করা
(৩) অবশিষ্ট রাজাদের অধীনতা মূলক মিত্রতার শৃঙ্খলে আবদ্ধ করা।
ক্ষমতায় আসার সঙ্গে সঙ্গেই ওয়েলেসলি মহীশূরের দিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখা শুরু করেন। ভারতের রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে তাঁর সম্যক ধারণা থেকে তিনি সহজেই বুঝতে পারেন যে টিপু ইংরেজের প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বীতে পরিণত হতে চলেছেন। টিপুর ফরাসী সাহায্য লাভের চেষ্টা তাঁকে প্রবল চিন্তিত ও ক্রুদ্ধ করেছিল। ওয়েলেসলি কয়েক মাসের মধ্যে কূটনীতির দ্বারা টিপুকে মিত্রহীন করে তাঁর বিরুদ্ধে জোট গঠন করতে অনেকটাই সমর্থ হন। হায়দ্রাবাদের সন্ধি ( ১৭৯৮ ) দ্বারা নিজাম ইংরেজদের সাথে অধীনতামূলক মিত্রতায় আবদ্ধ হতে বাধ্য হলে – নিজামের ফরাসী সেনাদল ভেঙে দেওয়া হয় ও টিপুর সাহায্য পাওয়ার পথ ও বন্ধ হয়ে যায়। নিজাম মহীশূর যুদ্ধে টিপুর বিরুদ্ধে কোম্পানিকে সাহায্য করতে প্রতিশ্রুতি দেন।
ওয়েলেসলি এরপর মারাঠা পেশোয়াদের কোম্পানির স্বপক্ষে আনার চেষ্টা করেন। কিন্তু দূরদর্শী মারাঠা নেতারা বুঝতে পারেন যে টিপুর পতন হলে দক্ষিণ ভারতে ইংরেজদের ক্ষমতা এতটাই প্রবল হতে পারে যা মারাঠাদের নিরাপত্তার ক্ষেত্রে বিপজ্জনক হয়ে পড়বে। তাই মারাঠারা কোম্পানির পক্ষে না যেয়ে নিরপেক্ষ থাকাই শ্রেয় মনে করে। পক্ষে আনতে না পারলেও মারাঠাদের এই নিরপেক্ষতা ওয়েলেসলির কাছে মহামূল্যবান ছিল এবং তিনি তাই যুদ্ধে জয়ী হলে টিপুর রাজ্যের একাংশ মারাঠাদের দেওয়ার ঘোষণা করেন।
এভাবে সমস্ত সামরিক ও কূটনৈতিক প্রস্তুতি সম্পন্ন করে শ্রীরঙ্গপত্তন সন্ধি অমান্য করা ও কোম্পানির বিরুদ্ধে ফ্রান্সের সঙ্গে আক্রমনাত্মক চুক্তি র অভিযোগে (আসলে অজুহাত) ওয়েলেসলি আকষ্মিক ভাবে মহীশূর আক্রমণ করেন। জেনারেল হ্যারিস মাদ্রাজ থেকে, জেনারেল স্টুয়ার্ট মালাবার থেকে ও জেনারেল আর্থার ওয়েলেসলি (পরবর্তী সময়ে বিখ্যাত ডিউক অফ্ ওয়েলিংটন) হায়দ্রাবাদ থেকে টিপুকে আক্রমণ করেন। সদাশিবের যুদ্ধে সেনাপতি স্টুয়ার্ট এবং মলভেলির যুদ্ধে সেনাপতি হ্যারিস টিপুকে পরাস্ত করেন। টিপু পিছু হটেন ও রাজধানী শ্রীরঙ্গপত্তন রক্ষার শেষ চেষ্টা করে বীর বিক্রমে যুদ্ধ করে ১৭৯৯ এর ৪ঠা মে মৃত্যু বরণ করেন।
কোম্পানি একাই যুদ্ধ করলেও ওয়েলেসলি তাঁর কূটনৈতিক বুদ্ধির পরিচয় স্বরূপ মহীশূর কে কয়েকটি ভাগে ভাগ করে বিভিন্ন শক্তির মধ্যে বন্টন করতে সচেষ্ট হন। নিজামকে তিনি মহীশূরের উত্তর-পূর্বাংশ ছেড়ে দেন এবং নিজে কানারা , কোয়েম্বাটুর ও ওয়েনাদ কোম্পানির অধীনে রাখেন। মহীশূরের মধ্যাঞ্চল সেখানের পুরাতন হিন্দু রাজবংশ কে বশ্যতা মূলক সন্ধি মেনে চলার শর্তে দান করেন। পূর্ব প্রতিশ্রুতি মতো মারাঠার পুণা দরবারকে সুন্ডা ও তৎসংলগ্ন অঞ্চল দিতে চাইলে মারাঠা দরবার এই প্রস্তাব নাকচ করেন। টিপুর পুত্র ও পরিজনদের ভেলোর দূর্গে বন্দী করা হয় ও পরবর্তীকালে তাদের কলকাতায় নির্বাসিত করা হয়। এরাই কলকাতায় টালিগঞ্জের নবাব হিসাবে খ্যাত ছিলেন।