পাঞ্জাবে মিসল্ যুগের গৃহযুদ্ধ ও কুশাসন দূর করে সুকারচেকিয়া মিসল্ এর অধিপতি মহারাজা রঞ্জিত সিং অখিল শিখ সাম্রাজ্য গঠন করেছিলেন। কিন্তু তাঁর মৃত্যুর পরেই এই সাম্রাজ্যের পতন ঘনিয়ে আসে। তিনি তাঁর পুত্রদের মধ্যে যোগ্য উত্তরাধিকারী হিসাবে কাউকেই শিক্ষা দিয়ে যাননি, মৃত্যুকাল অবধি নিজের হাতেই সব ক্ষমতা ধরে রেখেছিলেন। তাঁর গঠিত খালসা বাহিনী তাঁর মৃত্যুর পর চরম অসংযত হয়ে পড়ে এবং অসামরিক লোকের সম্পত্তি লুঠপাট থেকে দরবারের গোষ্ঠী দ্বন্দ্বের রাজনীতি – সর্বত্র জড়িয়ে পড়ে। এমনকি স্বার্থপর শিখ সর্দাররা বিভিন্ন গোষ্ঠী দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়ে ইংরেজদের সঙ্গে গোপনে আঁতাত করতেও পিছপা হয় না। এভাবেই রঞ্জিত সিং এর মৃত্যুর (১৮৩৯) পর শিখ সাম্রাজ্যের ভাঙনের চিহ্ন স্পষ্ট হতে থাকে।
মহারাজের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে তাঁর দুই পুত্র খরক সিং ও শের সিং এর মধ্যে সিংহাসনে বসার দ্বন্দ্ব শুরু হয়। লাহোর দরবারের সর্দাররা দুই পরস্পর বিরোধী দলে ভাগ হয়ে দুই প্রার্থীকে সমর্থন করেন। ডোগরা গোষ্ঠী খরক সিং ও শিখ গোষ্ঠী শের সিং কে সমর্থন করে। ডোগরা গোষ্ঠীর অধিক সামরিক শক্তি ও রাজনৈতিক প্রভাবের ফলে খরক সিং সিংহাসনে বসেন। পূরস্কার স্বরূপ ডোগরা গোষ্ঠীর নেতা ধ্যান সিং লাহোর দরবারে উজিরের পদ লাভ করেন। শের সিং আপাতত পিছু হটতে বাধ্য হন।
খরক সিং অপদার্থ ও অযোগ্য ছিলেন বলে তাঁর পুত্র নওনেহাল সিং পিতাকে প্রায় বন্দীদশায় রেখে শাসনকার্য পরিচালনা করেছিলেন। নওনেহাল ছিলেন তেজস্বী, বুদ্ধিমান ও দক্ষ প্রশাসক। কিন্তু দুর্ঘটনা বা চক্রান্তের ফলে তাঁর আকষ্মিক মৃত্যু শিখ রাষ্ট্রের স্থিতিশীলতা বিপন্ন করে। পুনরায় সিংহাসনের লড়াই শুরু হয়। আবার সেই ডোগরা গোষ্ঠীর প্রভাবে ও খালসা সেনার সাহায্যে এবার শের সিং সিংহাসনে বসেন। কিন্তু অচিরেই সান্ধা ওয়ালিয়া গোষ্ঠীর চক্রান্তে শের সিং বিশ্বাসঘাতকতার দ্বারা নিহত হন। তাঁর শিশুপুত্র প্রতাপ সিং ও উজির ধ্যান সিং-ও নিহত হন।
ধ্যান সিং এর পুত্র হীরা সিং ডোগরা ও খালসা সেনাদের নিজের পক্ষে এনে তাদের সাহায্যে মহারাজা রঞ্জিত সিং এর কনিষ্ঠ পুত্র দিলীপ সিং কে সিংহাসনে বসান। দিলীপ সিং এর মা রাণী ঝিন্দন দিলীপ সিং এর প্রতিনিধি হিসাবে শাসনকার্যের অধিকার পান। হীরা সিং উজিরের পদে বসেন। কিন্তু অচিরেই রাণী ঝিন্দন-এর ভাই জওয়াহার সিং এর চক্রান্তে হীরা সিং নিহত হন। লাহোর দরবারের শেষ যোগ্য ব্যক্তির এভাবে তিরোধান ঘটে। জওয়াহার সিং উজিরের পদে বসেন। রাণী ঝিন্দন তাঁর দাসী মঙ্গলা ও দরবারের লাল সিং এর কথায় ওঠা বসা করতে থাকেন।
দরবারের এই নেতৃত্বহীনতার সুযোগে খালসা বাহিনী রাজনীতিতে প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপ আরম্ভ করে। খালসা বাহিনীর “পঞ্চ্” অর্থাৎ পাঁচ নির্বাচিত সদস্যের নির্দেশে জওয়াহার সিং কে হত্যা করা হয়। লাল সিং উজিরের পদে বসেন।
অনেক ইংরেজ ঐতিহাসিক মনে করেন যে, পাঞ্জাবের এই অরাজকতা দমনে অক্ষম হয়ে রাণী ঝিন্দন ও লাল সিং খালসা সৈন্য কে কোম্পানির বিরুদ্ধে লেলিয়ে দেন। তাঁরা আশা করেছিলেন যে এর ফলে খালসা বাহিনী ধ্বংস হবে ও দরবারে শান্তি ফিরে আসবে। খালসা সেনাদের পরিচালনার জন্য কোন যোগ্য সেনা ছিল না। এই সেনা শতদ্রু পার হয়ে ইংরেজ আশ্রিত অঞ্চলে ঢুকলে ইঙ্গ- শিখ যুদ্ধ শুরু হয়। অচিরেই শিখ শক্তির পতন ঘটে।