আমরা আগে আলোচনা করেছি লর্ড মিন্টো পারস্য ও আফগানিস্তানের ভেতর দিয়ে নেপোলিয়নের আক্রমণের সম্ভাবনায় ভীত হয়ে রঞ্জিত সিং এর দরবারে মেটক্যাফ কে দূত হিসেবে পাঠিয়েছিলেন। এই আক্রমণের ভীতি থেকেই মিন্টো তথা ব্রিটিশ পাঞ্জাব ও সিন্ধুর সামরিক গুরুত্ব উপলব্ধি করেছিলেন। সিন্ধুর তৎকালীন শাসকরা আমীর উপাধিতে ভূষিত হতেন । ১৮০৯ তে মিন্টো এই আমীর দের সাথেও একটি অধীনতা মূলক চুক্তি স্থাপন করেন যার মাধ্যমে আমীর রা সেখানে কোন ফরাসি ঘাঁটি স্থাপন না করতে দেওয়ার অঙ্গীকার করেন।১৮২৫ খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশ দূত জেমস্ বার্ণিশ সিন্ধুর সম্পদ ও সিন্ধু নদীর মাধ্যমে বাণিজ্যিক বাড়-বাড়ন্তের সমূহ সম্ভাবনা সম্পর্কে কোম্পানিকে অবগত করেন।
মহারাজা রঞ্জিত সিং প্রতিবেশী সিন্ধু দেশে আধিপত্য স্থাপনের চেষ্টা করলে, সিন্ধুর সামরিক ও বাণিজ্যিক গুরুত্ব উপলব্ধি করে লর্ড উইলিয়াম বেন্টিংক তাঁকে নিরস্ত্র করার নীতি নেন। বেন্টিংকের নির্দেশে ইংরেজ দূত হেনরী পটিঞ্জার আমীর দের কোম্পানির সঙ্গে ১৮৩২ খ্রিস্টাব্দে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করতে একরকম বাধ্য করান। এই চুক্তির বিষয়বস্তু ছিল যে ইংরেজ বণিক ও ইংরেজরা সিন্ধু নদে অবাধে প্রবেশ ও বাণিজ্য করতে পারবে ; তবে কোন যুদ্ধ জাহাজ বা সামরিক ঘাঁটি ইংরেজরা স্থাপন করবে না, তথা কোম্পানি সিন্ধু দেশের কোন অঞ্চল অধিকার করবে না। আপাত অর্থে এই চুক্তির দ্বারা কোম্পানি সিন্ধুতে বাণিজ্যিক সাম্রাজ্যবাদ কে বিস্তার করলেও, সেখানে রাজনৈতিক আধিপত্য বিস্তার হতে আর বিশেষ সময় লাগে নি।
পরবর্তী গভর্নর জেনারেল লর্ড অকল্যান্ড আফগান যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েন। তিনি ১৮৩২ এর চুক্তিকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে সিন্ধু নদের উপর ব্রিটিশ সেনাবাহিনী পাঠান এবং সিন্ধু দেশকে ব্রিটিশ ঘাঁটি তে পরিণত করেন। এমনকি ব্রিটিশ সেনার ব্যায় নির্বাহের জন্য তিনি আমীর দের কাছে অর্থ দাবী করে বসেন! আরো একধাপ এগিয়ে তিনি আমীর দের উপর ১৮৩৯ খ্রিস্টাব্দে এক নতুন সন্ধি জোরপূর্বক চাপিয়ে দেন যাতে বলা হয় যে সিন্ধু দেশে ব্রিটিশ অধীনতা মূলক মিত্র সৈন্য অবস্থান করবে এবং করাচী বন্দর ব্রিটিশ সামরিক ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহার করা হবে।
পরবর্তী গভর্নর জেনারেল লর্ড এলেনব্যরো অধীনতা মূলক মৈত্রীর পরিবর্তে সিন্ধু দেশে প্রত্যক্ষ ব্রিটিশ শাসন স্থাপনের মনস্থির করেন। আফগান যুদ্ধে ব্রিটিশ দের শোচনীয় পরাজয়ে ব্রিটিশদের সামরিক মর্যাদা যেভাবে ভূ-লুন্ঠিত হয়েছিল, তা খানিকাংশে পুনরুদ্ধার করতেই এলেনব্যরো র সিন্ধু দেশ অধিগ্রহণের ন্যায় নীতি হীন সিদ্ধান্ত। অজুহাত ছিল এই যে আফগান যুদ্ধে আমীর রা নাকি কোম্পানির বিরোধিতা করেছিলেন! আমীর দের নানাভাবে উৎপীড়নের জন্য স্যার চার্লস নেপিয়ার কে ১৮৪২ খ্রিস্টাব্দে সিন্ধু র নতুন ইংরেজ রেসিডেন্ট নিযুক্ত করা হয়। নেপিয়ার আমীর দের উত্তরাধিকারে অযাচিত হস্তক্ষেপ করেন, আমীর দের নিজস্ব মুদ্রা বাতিল করে কোম্পানির মুদ্রা চালু করেন এবং তাঁদের রাজ্যের একাংশ কোম্পানি কে ছেড়ে দেবার চাপ দেন। তিনি ইমামগড় দূর্গ ভেঙে ফেলার পর আমীর রা বাধ্য হয়ে ব্রিটিশ দের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন। নেপিয়ার ও সেনাপতি আউট্রাম মিয়ানি ও দাবোর যুদ্ধে আমীর দের পরাস্ত করেন। সিন্ধু দেশ ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়।
এলেনব্যরো র এই নগ্ন সাম্রাজ্য নীতি সর্বত্র নিন্দিত হয়েছে। এমনকি নেপিয়ার সিন্ধু দেশ অধিগ্রহণের পর দ্ব্যর্থবোধক ভাষায় বলেন – I have Sind (sinned) । পার্সিভাল স্পিয়ার এই নীতিকে ফ্যাসিস্ট আচরণ বলে নিন্দা করেছেন। লন্ডনের টাইমস্ পত্রিকা সিন্ধু অধিগ্রহণের এই নীতিকে “আগাগোড়া পচনশীল” বলে মন্তব্য করে।